অনেক বাবা মাকে , বিশেষ করে শহরের বাবা মা কে দেখা যায় তারা বাচ্চাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেন একদম নিয়ম করা ঘড়ি ধরে, তার খিদে লাগুক বা না লাগুক। বাচ্চার বয়স ৬ মাস হোক কি ৬ বছর, বা ১০ বছর, তবুও তাকে তারা খাইয়ে দেন। শিশু বয়সে খাইয়ে দেয়ার সময় তারা মাথায় রাখেন, সে তো এখন বাচ্চা , নিজের হাতে তো খেতে পারবে না। বড় হলে না হয় নিজের হাতে খাবে। তাদের এই ভাবনাই পরবর্তীতে চলতে থাকে, এ থেকে তারা বের হতে পারেন না। হয়তো বের হতে চান, কিন্তু সন্তানের যে অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়, সেই অভ্যাস তাকে তা থেকে আর বের হতে দেয় না। আবার অনেক মা আদরের ধন বলেই সন্তানকে বড় হওয়ার পরেও খাইয়ে দেন। এমনকি দেখা যায় বাচ্চার বয়স ১০ বছর হয়ে গেসে, বা তারো বেশি ১৪/১৫বছর কোনো কোনো ক্ষেত্রে , তখনো তারা খাইয়ে দেন। এই যে বাচ্চা যথেষ্ট বয়স হয়ে যাওয়ার পরেও তাকে খাইয়ে দেয়া, এটা কিন্তু তার সাথে সঠিক বিহেভ না, এটাই সেই আচরণগুলোর মধ্যে একটি আচরন যা আপনার সন্তানকে দায়িত্ববান করে গড়ে উঠতে বাধা দেয়।
তাছাড়া বাচ্চার বাবা মায়েদের আরেকটি অভিযোগ করতে শুনা যায় সবসময়, আর তা হল, “বাচ্চা খেতে চায় না”, “বাচ্চার খাবারের প্রতি অনীহা”। গ্রামের বাবা মায়ের তো কখনো এই ধরনের অভিযোগ করতে শুনা যায় না, বরং তাদের বাচ্চাদের দেখা যা পায় তাই খায়, না পাইলে খায় না, এর কারণ কি ? আসলে এটারও বড় কারণ এই সময় ধরে ধরে তিন বেলা নিজ হাতে খাইয়ে দেয়া। “না চাহিতে যারে পাওয়া যায়”, তার প্রতি কি আগ্রহ থাকে বলেন। খুদা লাগার আগেই যদি খাবার ঠেসে ধরেন, তবে কিভাবে বুঝবে সে খাবারের মর্ম। তাই খাবারের মর্ম তাকে বুঝতে দিন। তাকে খিদায় একটু কাঁদতে দিন। বলতে দিন, “আম্মা খাব”। যখন সে এটা বলবে, তখনই তাকে খাবার দিন, তাও তাকে নিজ হাতে না খাইয়ে তাকেই বলুন তার হাতে খেয়ে নিতে। গ্রামের বাচ্চাদেরকে তাদের বাবা মায়েরা এভাবে খাওয়ান না , বা সময় হয় না এভাবে খাওয়ানোর যেকারনে তাদের ক্ষেত্রে এই অভিযোগ কম। গ্রামে যারা এই অভিযোগ করেন, তাদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় সেখানে বাচ্চাকে এই সময় ধরে খাওয়ানোর চর্চা বিদ্যমান। হ্যাঁ, বয়স ৬ মাস-১ বছর এই সময়টায় বাচ্চাকে খাইয়ে দিতেই হবে স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরে ? এর পরেও খাওয়াবেন, কিন্তু পুরাপুরি একটিভ না থেকে তাকে খেতে দিবেন, মাঝে মাঝে এসে দুয়েক লোকমা মুখে দিয়ে দিবেন। এভাবে যত দিন যাবে, আস্তে আস্তে আপনার উপর তার যে নির্ভরতা, তা কমিয়ে আনবেন ।
আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, বাসায় সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়ার প্র্যাক্টিস করা। এটা কিন্তু সুন্দর একটি কালচার। শহরে বেশিরভাগ ফ্যামিলিতে এই প্র্যাক্টিসটা নাই। যে যার মত সময়ে খাচ্ছে, এতে যেমন কালচার হারিয়ে যাচ্ছে, ফ্যামিলি বন্ডিংয়েও তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। তাই এই অভ্যাসটি করতে হবে যত কষ্টই হোক। সবাই মিলে যখন খাবেন, তখন আপনার বাচ্চাকেও সাথে বসিয়ে বা পাশের চেয়ারে বসিয়ে তার সামনে কিছু খাবার দিন। সবাইকে যখন খেতে দেখবে, সে নিজেও তখন তার বাটিতে রাখা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করবে, বা অন্তত নাড়াচাড়া করবে না খেলেও। এতটুকু লাভ হওয়াও কিন্তু যথেষ্ট।
বাচ্চা যদি কম খায়, তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তার পাকস্থলী কিন্তু আমাদের মত না। তাদের পাকস্থলী আকারে যেমন ছোট, হজম ক্ষমতাও দুর্বল। আমরা হয়তো ভরাপ্লেট খাওয়ার তিন ঘন্টা পরেই পাকস্থলী খাবার হজম করে খালি হয়ে যায়। কিন্তু বাচ্চার ছোট পাকস্থলি খাবার নেয়ও কম, আর হজম শক্তি দুর্বল হওয়ার কারণে তা হজম হতেও টাইম লাগে বেশি। যখন আমাদের একবেলা গড়িয়ে আরেকবেলার খাবারের টাইম হয়ত তখনও হয়তো তার প্রথম বেলার খাবারের হজম প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। তাই এসব নিয়ে এতো দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই ।
মানবশিশু আর অন্য যেকোনো প্রাণীশিশুর মধ্যে তফাত এটাই যে, মানবশিশুর দেহের সাথে সাথে মেধার তথা মানসিক বিকাশের প্রয়োজন আছে। প্রাণীর ক্ষেত্রে কেবল দেহের বিকাশই যথেষ্ট। তবে কেন আমরা শুধু বাচ্চার দেহের বিকাশ নিয়েই শুধু চিন্তা করে রাতদিন এক করে ফেলছি। এই সময়টা কি ওর মেধা বিকাশের দিকেও নজর দেয়া উচিত না ? সে যে মানবসন্তান , এটা ভুলে গেলে কি চলবে ?