বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত হওয়া নতুন সিলেবাস ও শিক্ষাপদ্ধতি এবং এর ব্যপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি অভিভাবকদের মাঝে। কেউ সাধুবাদ দিচ্ছেন তো কেউ বলছেন শিক্ষা রসাতলে যাচ্ছে। আমার অবস্থান এ দুটোর মাঝামাঝি। প্রথমের এর ভালো দিকগুলো বলে নিচ্ছে।
প্রথমত, আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে যে বই নির্ভর মুখস্তবিদ্যা চলে আসছে আর পরীক্ষায় তা বমি করে পরে সব ভুলে যাওয়ার ট্রেন্ড , এ থেকে আদতে কিছুই শেখা হত না। ্পুরা স্কুল লাইফে বায়োলজীতে ভালো ছিল, কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হয় ইঞ্জিনিয়ারিং এ , আর প্রফেশনে গিয়ে চাকরী করে ব্যাংকে বা বিসিএস দিয়ে হয় পুলিশ। মানে, কোনো কিছুর সাথে কিছুরই যেনো মিল নেই – এমন জগাখিচুড়ী অবস্থা। শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষ গড়া – এটার মুখেই বলি কিন্তু ম্যানার, এটিকেটসহ যত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কোনো কিছু শেখার মত কোনো কন্টেন্টই এই পুরা সিস্টেমে নাই ।
একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, আপনি যখন কোনো কিছু জানার উদ্দেস্যে উইকিপিডিয়া পড়েন, বা কারো সাথে আড্ডা দেন কোনো প্রোডাক্টিভ বিষয়ে, তখন কিন্তু যা জানেন বা শেখেন তা আপনার মাথায় গেথে যায় কিন্তু ঠিক একই জিনিস আপনি যখন পরীক্ষায় লিখতে হবে – এই নিয়তে বসে পড়াশোনা করা এপ্রোচ নিয়ে শিখতে যান, তা মাথায় ঢুকে কম, এবং শিখতেও সময় লাগে। এর কারণ, আমাদের ব্রেইন সাবকনশাস মাইন্ডে পাওয়া তথ্যকে মনে রাখে বেশি আর ব্রেইন যখন কনশাস হয়ে এটা ভাবতে থাকে যে সে পড়ালেখা করছে তা তখন মনে থাকে কম, এবং মজাও পাওয়া যায় কম।
নতুন সিস্টেমে যেভাবে শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে তা প্র্যাক্টিক্যালি এপ্লাই করার মাধ্যমে শেখানোর উপর জোর দেয়া হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তা শিক্ষ্যার্থী মজা দেবে, এবং তারাও পড়ালেখার নিয়তে না, বরঞ্চ জানার নিয়তেই তাঁর জানবে এবং পড়বে। তাই সেই পড়া কাজে লাগবে , এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সিক্স সেভেনের কিছু কন্টেন্টে দেখলাম আছে মানি ম্যানেজমেন্ট, কেয়ারগিভিং ইত্যাদি। একজন সচেতন মানুষের মানি ম্যানেজমেন্ট অবশ্যই শেখা উচিত। একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ দরকার। অথচ আমাদের দেশে এই জিনিসটাকে সযতনের এভয়েড করে যাওয়া হত টাকাকে খারাপ দেখিয়ে, যেটা খুবই ভুল। এখন এখান থেকে বের হওয়া যাবে এই শিক্ষার মাধ্যমে এটা আশা করা যায়।
এই নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ও সিলেবাস নিয়ে অসন্তুষ্টির বেশ কিছু জায়গাও আছে। যেগুলা নিয়েও কথা বলা উচিত বলে মনে করি।
প্রথমত, বাচ্চাদের বয়স ও শ্রেনী অনুযায়ী কন্টেন্ট দেয়া হয়নি বলে মনে হয়েছে। যেমন , বিছানা গোছানো ক্লাস ৫/৬/৭ এর শিক্ষা হিসেবে দেয়া হয়েছে, যেটার যৌক্তিকতা নেই। বরঞ্চ এটা আরো নিচের ক্লাসে দেয়া উচিত ছিল। এরকম বেশ কিছু কন্টেন্ট আছে, যেটা হওয়া উচিত আরো প্রাইমারী লেভেলের ক্লাসে, হাইস্কুলে না।
রান্নাবান্নায় দলগতভাবে একটা ডিশ রান্না করা একটা পিকনিক ফিল দিলেও তা ব্যক্তিগতভাবে পুরো রান্না শেখাবে না। দেখা যাবে, একজন পুরো রান্নাটা করতে পারছে, বাকিরা ফাঁকিবাজি করে শুধু খেয়েই গেল। আবার অনেক জায়গায় দেখা যায়, পুরো রান্নাটাই করতেসে অন্য কেউ। ছাত্রছাত্রী শুধু দেখতেসে। এটাও রান্না শেখাবে না। তাছাড়া কমপ্লেক্স রান্না যেমন, খিচুড়ী বিরানী ইত্যাদি না শিখিয়ে লাইফ সেইভিং বা সার্ভাইভিং এবং ম্যান্ডেটরী আইটেম রান্না শেখানো উচিত। যেমন, ভাত, ভর্তা, মাছ, ডিম ইত্যাদি। পার্টি করা লাইফের জন্য জরুরী না, কিন্তু নিজে নিজে সার্ভাইভ করার জন্য বেসিক খাবার তৈরি করাটা জরুরী । আর এখানেও এই ভাত ভর্তা তৈরির শিক্ষাটা আরো প্রাথমিক লেভেলে দেয়া উচিত, এবং তা দলগতভাবে না বরঞ্চ এককভাবে প্রত্যেকে বা ২/৩ জন মিলে গ্রুপ করে।
দ্বিতীয়ত,সবচেয়ে বড় নেগেটিভ দিক হচ্ছে, এই শিক্ষাপদ্ধতিতে মোবাইলকেও ছাত্রদের ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা তাদেরকে বাড়ির কাজ হিসেবে কিছু একটা করতে বলতেসে, আর সেই কাজের ছবি তুলে মোবাইলে করে নিয়ে এসে দেখাতে হবে – এটা খুবই অনুচিত। শিক্ষাটা পুরোপুরি ডিভাইসমুক্ত করা উচিত। যেখানে বাচ্চাদের ১৫-১৮ বছরের আগে মোবাইল দিতে নিষেধ করা হয় উন্নত দেশে, সেখানে আমরা কি করছি !
এই পদ্ধতিতে শিক্ষক ও ছাত্রদের পাশাপাশি অভিভাবকদের হেল্পফুল হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ঝামেলা কমাতে হোক বা অন্যদের চেয়ে নিজের বাচ্চাকে এগিয়ে দিতে হোক, অভিভাবক নিজেই গুগল করে বাচ্চাকে বাড়ির কাজ দেখায়ে দিচ্ছে বা করে দিচ্ছে, যেটা তাঁর (অভিভাবকের) করার কথা না। এটা যেমন আনইথিক্যাল তেমনি শিক্ষার যেই উদ্দেশ্য, ছাত্রকে শেখানো – তা ব্যহত করছে।
কেজি থেকে দশম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষাস্তরকে দুই ভাগের মধ্যে রাখা উচিত। প্রাইমারী সেকশকঃ ১ম – ৫ম শ্রেনী, এখানে পুরো শিক্ষা হওয়া উচিত লাইফস্টাইল শিক্ষা, ম্যানার শিক্ষা, বিভিন্ন জায়গায় কিভাবে চলতে হবে, বলতে হবে, খেতে হবে ইত্যাদিসহ যা কিছু একটা মানুষকে লাইফ সম্পর্কে ধারণা দেয় তা এখানে থাকবে। সাথে থাকবে বেসিক লেখাপড়া। প্যাক প্যাক করা, ব্যঙ এর ডাক, হাম্বা যা কিছু আছে তা এর মধ্যে ২য় শ্রেনীর মধ্যে এই পদ্ধতিতে শেখানো যায়। জ্যামিতিক শেইপ, কালার, অক্ষর, শব্দ , বাক্য ইত্যাদি শেখা সহ বেসিক সব জিনিস এখানে থাকবে।
৬ষ্ঠ – ১০ম শ্রেনী, এখানে হওয়া উচিত মূল কেতাবী শিক্ষা যা হবে মিনিংফুল এবং ইম্প্যাক্টফুল। ম্যাথ, সায়েন্স ইত্যাদি। এখন যা হচ্ছে, নতুন কণ্টেন্ট যোগ করতে ম্যাথ এবং সায়েন্সের অনেক টপিক বাদ দেয়া হয়েছে, যেটা একেবারেই ভুল কাজ হচ্ছে। বাইরের দেশে যেখানে স্কুলের বাচ্চারা ম্যাথ অলিম্পিয়াডে যোগ দেয়ার মত গাণিতিকভাবে দক্ষতা অর্জন করে, প্রোগ্রামিং এর সাথে পরিচয় করানোহয়। সেখানে আমরা যদি ম্যাথকে আরো কমিয়ে দেই – সেটা কখনো বাস্তবিক শিক্ষা হতে পারে না। বরঞ্চ, বাংলাকে কমিয়ে দেয়া উচিত। সমাস,কারক, সন্ধি, ব্যসবাক্যসহ আরো যা আমরা পড়সি, এগুলা কিছুই আসলে দরকার হয়না। বাংলা থাকা উচিত শুধুমাত্র প্রাইমারী ক্লাসে। সমাস, কারক সহ যা আমরা পড়েছি তা অনার্সের কন্টেন্ট হিসেবেই থাকুক।
নতুন এই শিক্ষাদানে শিক্ষকদের শিক্ষা পদ্ধতি যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। তাই এই শিক্ষা প্রয়োগের আগে বরঞ্চ শিক্ষকদেরকে ট্রেইনিং দেয়া উচিত লম্বাসময় ব্যাপী। সপ্তাহ-মাস ব্যাপী ট্রেইনিং যথেষ্ট না, বরঞ্চ এই ট্রেইনিং হওয়া উচিত বছর ব্যাপী। মাস্টার্স যেরকম ২বছরের কোর্স, তেমনি নতুন এই শিক্ষাপদ্ধতি শেখাতে বছরব্যাপী সার্টিফাইড কোর্স চালু করা উচিত। যখন যথেষ্ট পরিমাণ শিক্ষক তৈরি হবে যা এই শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে, তখনই এই নতুন সিলেবাস এপ্লাই করা উচিত ছিল শিক্ষাক্রমে।
আসলে পুরো জিনিসটায় খুব তাড়াহুড়া করে ফেলা হয়েছে যেটা না করলেই ভালো হত বলে মনে করি। হয়তো Trial and error এর মাধ্যমে সংশোধন আনা হবে ধাপে ধাপে, কিন্তু তা ই কি সঠিক, উত্তর বা একমাত্র পদ্ধতি ?